নয়াচীন যে কারণে বঙ্গবন্ধুকে মুগ্ধ করেছিল | আমার দেখা নয়াচীন | Bangla Book Review by Enayet Chowdhury

আমার দেখা নয়াচীন বইটার মূল ঘটনা- ১৯৫২ সালের ২ থেকে ১২ই অক্টোবর চীনের পিকিং (যেটা এখন বেইজিং নামে পরিচিত) ওই শহরে এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় আঞ্চলিক শান্তি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

নয়াচীন যে কারণে বঙ্গবন্ধুকে মুগ্ধ করেছিল | আমার দেখা নয়াচীন | Bangla Book Review by Enayet Chowdhury
 এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় আঞ্চলিক শান্তি সম্মেলন

তো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ওই সময় পাকিস্তান প্রতিনিধি দলের সদস্য হয়ে সেই নয়াচীন ভ্রমণ করতে যান। ১৯৫৪ সালে বঙ্গবন্ধু যখন রাজবন্দী ছিলেন তখন কারাগারে বসে এই আমার দেখা নয়াচীন বইটি লিখেন। এই লেখাতে আমি দেখাবো তৎকালীন সদ্য বিপ্লব শেষ করা যে নতুন চীনের জন্ম হইছিল তার কী এক্সক্লুসিভ বৈশিষ্ট্যগুলা ছিল, যেইটা আপনার জানা জরুরী! কাশ্মীর বা পাকিস্তানের মতোন ইস্যুগুলাতে তৎকালীন রাষ্ট্রনেতারা আসলে কী পয়েন্ট অফ ভিউ রাখতো? আর সকল চড়াই-উতরাই পারি দিয়ে পাণ্ডুলিপিটা আজকে যে বইয়ের রূপ নিছে এইটার পেছনের গল্পটা আসলে কি! এই পুরো ব্যাপারটি আমি আপনাদের সামনে উপস্থাপন করবো। তো চলুন শুরু করা যাক।😄

আপনি যখন চায়না নিয়ে কোনো কথা বলবেন আপনার সামনে প্রথমে কমিউনিজম কনসেপ্টটা আসবে যে সকলে সমান (সাম্যবাদের ব্যাপারটা…), কিন্তু বঙ্গবন্ধু যখন নয়াচীন সফর করতে যান তখন তার একটা ভিন্নরূপ আমরা দেখতে পাই, যেখানে আমরা সাম্যবাদের কথা বলতেছি, ওদের সেই কমিউনিজমের ভিতরেও কিছুটা অসাম্য ছিল! পুরাপুরি সবাই সাম্যতা মেনে চলতো না বা সব জায়গায় একদম বিশুদ্ধ যে কমিউনিজমের কথা আমরা বলি সেটা হয়তো ছিল না। 

“রেলগাড়ির কথা বলি। কম্যুনিস্ট দেশ বলে সকলে সমান হয়ে যায় নাই। ট্রেনে দু’রকম ক্লাস আছে, ‘নরম ক্লাস আর শক্ত ক্লাস’। ভাড়ায়ও ব্যবধান আছে। প্রায় দু’গুণ। একটায় গদি আছে আর একটায় গদি নাই। হেলান দিয়ে দু’জন করে বসতে পারে বেঞ্চিতে। রাতে ঘুমাবার বন্দোবস্ত আলাদা রুমে হয়। সেখানেও দিনে থাকা যায়। নরম ও শক্ত ছাড়া সুবিধা প্রায় সমান।”(পৃষ্ঠা ৩০)

ঠিক ওই মোমেন্টেই রেলগাড়ি নিয়ে আরেকটা এক্সপেরিয়েন্স এখানে শেয়ার করা হইছে যেইখানে চাইনিজ Patriotism বা চাইনিজদের যে দেশপ্রেমটা আছে সেটা অনেক ভালোভাবে বোঝা যায়। কাহিনীটা হচ্ছে উনারা রেলগাড়ি দিয়ে যাইতেছিলেন হঠাৎ করে টিটি আসছে, তো ওইখানে টিকেট চেক করার রীতিটা একদমই ছিল না।

“পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার দিকে খুব খেয়াল। গাড়িতে খাবার ঘরও আছে। যাদের খাওয়ার দরকার খেয়ে নেয়। টিকিট চেকার সাহেব মাঝে মাঝে ঘুরে যান। তবে যতদূর জানলাম বিনা টিকেটে কেহ ভ্রমণ করে না।  একজন টিকিট চেকার সাহেবকে জিজ্ঞাসা করলাম, আমার দোভাষীর মাধ্যমে- আপনি টিকিট ছাড়া লোক কত দিন দেখেন নাই? সে বললো, প্রায় দেড় বৎসর। তবে যদি গাড়ি ছাড়ার সময় তাড়াতাড়ি উঠতে হয়, তবে পরের স্টেশনে আমাকে খবর দেয় আমি টিকিট দিয়ে আসি। আজকাল আর আমাদের টিকিট চেক করতে হয় না,  কারণ কেহই বিনা টিকিটে গাড়িতে উঠে না। আর ফাঁকি দিতেও চেষ্টা করে না। তারা মনে করে এ পয়সা তাদের নিজেদের, রাষ্ট্র তাদের,  গাড়ি তাদের, নিজেকে ফাকি দিয়া লাভ কী?”(পৃষ্ঠা ৩১)

এইযে মেন্টালিটিটা যে রাষ্ট্রের সম্পদ আসলে আমারও সম্পদ এইটা নয়াচীনের মধ্যে ১৯৪৯ এর পরে যখন পিপলস রিপাবলিক অফ চায়না আসছে ওইসময় বেশ ভালোভাবেই যে শুরু হইতে পারছিলো, এটা চায়নার জন্য অনেক বড় একটা ভাগ্যের ব্যাপার যেটা আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত আমরা করতে পারিনাই(😞)।

দ্বিতীয় ব্যাপারটা হচ্ছে কমিউনিটি এনগেজমেন্ট। চাইনিজরা কমিউনিটির মাধ্যমে কিন্তু অনেক বড় বড় স্ট্রাকচার সেসময় বিল্ডআপ করছে। কমিউনিটি এনগেজমেন্ট কথাটার মানে হইতেছে মনে করেন আপনার এলাকার মধ্যে একটা বাঁধ বানানো লাগবে, তখন ওই এলাকার মানুষরাই যদি নিজেদের শ্রম দিয়ে নিজেদের এলাকার বাঁধটা নির্মাণ করে ফেলে এটাকেই বলা হয় কমিউনিটির মাধ্যমে আপনি ওই এলাকার ডেভেলপমেন্টটা করতেছেন। এটাকে বলা হয় কমিউনিটি এনগেইজমেন্ট। এখনকার ফিলসফি অনুযায়ী বাংলাদেশের যেকোনো ডেভেলপমেন্ট কাজে এই কমিউনিটি এনগেজমেন্টকে অনেক বেশি পরিমাণে গুরুত্ব দেয়া হয় তার কারণ  কমিউনিটি যদি একবার নিজের মনে করে ওই ডেভেলোপমেন্ট প্রজেক্টটার মধ্যে এনগেজড হয়ে যাইতে পারে, আপনি যদি কমিউনিটিকে উদ্বুদ্ধ করতে পারেন ওইটার রেজাল্ট অনেক বেটার দেখা যায় উইথ রেসপেক্ট টু আপনি যদি কোনো ঠিকাদারকে দিয়ে এটা বানানোর চেষ্টা করেন কিংবা ওই এরিয়ার বাইরের কাউকে দিয়ে বানানোর চেষ্টা করেন। সো এই কমিউনিটি এনগেজমেন্টের ধারণাটা যেটা বাংলাদেশে হয়তো রিসেন্ট বিশ পঁচিশ বছরের মধ্যে খুব বেশি পরিমাণে ডেভেলপড হইছে। এই ধারণাটা সেই ১৯৪৯ পরবর্তী নয়াচীনের মধ্যেও ছিল। এইটার দুইটা এক্স্যাম্পল আমি আপনাদেরকে দেই।

“একটা কথা আপনাদের বলতে ভুলে গেছি। আমরা ৩৬৭ জন ডেলিগেট, ৩৭ জন পর্যবেক্ষক, ২৫ জন আন্তর্জাতিক সংগঠনের প্রতিনিধি ৩৭টা দেশের থেকে সেখানে যাই। কিন্তু এত লোকের থাকার জায়গা হঠাত দেওয়া কষ্টকর মনে করে চীন সরকার জনসাধারণকে অনুরোধ করলো যে, বিদেশ থেকে তোমাদের অতিথি আসবে তাদের জন্য একটা চারতলা দালান করতে হবে। সমস্ত লোক ঝাঁপাইয়া পড়লো,(কমেন্ট : দ্যাট ইজ কলড কমিউনিটি এনগেজমেন্ট!) ৭০ দিনে বিরাট চারতলা এক দালান করে ফেললো। তা দেখে তো আমাদের চক্ষু চড়কগাছ! আমরা দেখি সরকারি কাজ কন্ট্রাক্টর সাহেবরা আস্তে আস্তে করেন। অনেক কিছু কারুকার্য হয়। যত অল্প পয়সায় কাজ হবে ততই তাদের লাভ হবে ইত্যাদি। আমরা জিজ্ঞাসা করলাম, জনসাধারণ ঝাঁপাইয়া পড়লো কেন? জানলাম জনগণ ভাবে এটা তাদের কাজ। তাই তারা যে যতদিন পারে খেটে দেয়, কারো উপর জোর নাই। আমাদের রাষ্ট্রদূত বললেন যে ৭ দিন তার কোনো চাকর ছিল না। কারণ  জাতীয় সরকার ডাক দিয়েছে, দেশের কাজে তাদের সাহায্য করা কর্তব্য। তাই তারা রাষ্ট্রদূতকে বলে চলে গেল। রাষ্ট্রদূতের বেগম সাহেবার নিজেরই পাক করে খেতে হয়েছে।”(পৃষ্ঠা ৩৯)

That is called “Community Engagement” for the love of your own country!😀

ঠিক একই জিনিস রাস্তা নিয়েও বলা আছে…

“জনগণ বুঝতে পারে এ কাজ তাদেরই মঙ্গলের জন্য, তাই সরকার যখনই ডাক দেয়, লক্ষ লক্ষ লোক  তাতে সাড়া দেয়। এক জায়গায় শুনলাম, সরকার ডাক দিলো- ‘এক শত মাইল একটা রাস্তা করতে হবে। তোমাদের যথেষ্ট অসুবিধা হতেছে;  সরকারের অত টাকা নাই, তাই তোমাদের নিজেদের কাজ নিজেদের করাই উচিত। প্রত্যেকের আসতে হবে, অন্তত ২ দিন কাজ করে দিতে হবে। সমস্ত লোক এসে কাজ শুরু করলো, সরকার তাদের খাবার দিলো। নারী পুরুষ নির্বিশেষে ১ মাসের ভিতর সমস্ত রাস্তা করে দিলো।”(পৃষ্ঠা ৯১)

১৯৭২ সালে ঢাকা স্টেডিয়ামে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের একাংশ :-

“তোমাদের কাছে আমি চাই, যে যেভাবে যদি আরো দু’মাস লাগতো কি তিনমাস লাগতো স্বাধীন হতে, তো তোমরা যুদ্ধ করতা না? যদি এক বচ্ছর লাগতো, যুদ্ধ করতা না? না খেয়ে কষ্ট করতা না? তোমরা শত্রু মোকাবেলা করতা না? গুলি খেয়ে মরতা না? এই এক বচ্ছর তোমাদের সর্বস্ব ত্যাগ করে আমার দেশের গঠনমূলক কাজে আত্মনিয়োগ তোমাদের করতে হবে, করবা? রাস্তা তোমাদের নিজেদের করতে হবে। ব্রিজ তোমাদের নিজেদের করতে হবে। ফসল উৎপাদন তোমাদের করতে হবে। গ্রামে গ্রামে তোমাদের কাজ করতে হবে। শান্তি শৃঙ্খলা তোমাদের এরিয়াতে তোমাদের রাখতে হবে।করবা?আমি জানি তোমরা করবা। যখন আমি ছিলাম না তখনই যখন আমার কথামতো তোমরা করেছো! নিশ্চয়ই করবা!”

নয়াচীন যে কারণে বঙ্গবন্ধুকে মুগ্ধ করেছিল | আমার দেখা নয়াচীন | Bangla Book Review by Enayet Chowdhury
১৯৭২ সালে ঢাকা স্টেডিয়ামে বঙ্গবন্ধু। Source: www.bdun.org

এইরকম জাস্ট একটা দুইটা প্রজেক্ট না এইরকম হাজার হাজার প্রজেক্ট চাইনিজ জনগণ যারা আছে তারা করে দিছে সরকারের জন্য, এন্ড এইটার জন্য তারা নিজেরাই গর্ব অনুভব করে কারণ এইটা তাদের নিজেদের দেশের কাজ হিসেবেই তারা মনে করে।

তৃতীয় aspect, চাইনিজদের নিজেদের মাতৃভাষার প্রতি যে সম্মানটা এইটা এই বইয়ের অনেক জায়গাতেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কিন্তু উল্লেখ করছে। একটা জায়গায় বইয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার সাথে যারা ছিলেন সবাই মিলে নানকিং বিশ্ববিদ্যালয় (সম্ভবত), সেটার ভাইস চ্যান্সেলরের সাথে দেখা করতে যান। তো একটা ভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর উনি কিন্তু যথেষ্ট ইংরেজি জানেন কিন্তু তারপরেও উনি একজন দোভাষীর মাধ্যমে ওই ডেলিগেট টিমের সাথে কথা বলতেছিলেন। তার কারণ উনি নিজে চাইনিজ ছাড়া অন্য কোনো ভাষা বলবেন না। যদিও তিনি ইংরেজি জানেন!

“ভাইস চ্যান্সেলর চীনা ভাষায় বললেন, দোভাষী ইংরেজি করে দিলেন। এখানেই আমি দেখলাম যে, দোভাষী যখন ২/১ জায়গায় ভালোভাবে ইংরেজি করতে পারছে না, সেখানে ভাইস চ্যান্সেলর নিজেই ওকে ইংরেজি করে দিচ্ছে। ভদ্রলোক ভালো ইংরেজি জেনেও ইংরেজি বলেন না। জাতীয় ভাষায় কথা বলেন। আমরা বাঙ্গালী হয়ে ইংরেজি আর উর্দু বলার জন্য পাগল হয়ে যাই বলতে না পারলেও এদিক ওদিক করে বলি।”(পৃষ্ঠা ৬৮)

এখানে খেয়াল রাখতে হবে উনার সাথে কিন্তু ওইসময় পীর মানকি শরীফ ছিলো যার পুরো নাম হচ্ছে পীর আমিনুল হাসনাত উনি মুসলীম লীগের একজন নেতা ছিলেন। উনি কিন্তু উর্দুতে কথা বলতেছিলেন। যেটা স্বভাবতই বুঝা গেছে এইটা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পছন্দ না।

চার নাম্বার জিনিস, এখন আমরা আসি ওদের প্রিন্টিং প্রেসের ব্যাপারে। তখন বঙ্গবন্ধুর মতামতটা কী ছিল? আমরা তো এখন চাইনিজ মিডিয়ার উপরে খুব একটা বেশি ভরসা রাখতে পারি না। বাট ওইসময়ে প্রেসের ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু একটা মতামত দিছিলেন। এইখানে ঘটনা হইতেছে পহেলা অক্টোবর এটা হচ্ছে নয়াচীনের স্বাধীনতা দিবস যেটাকে লিবারেশন ডে বলে ওরা। বিশাল এক প্যারেড হইছিলো, মাও সে তুং ও আসছিলো ওই জায়গাটার মধ্যে। আপনারা যারা মাও সে তুং কে চিনেন না, তারা একটু গুগল কইরা নিয়েন।চীনের খুব বড় একজন নেতা!

নয়াচীন যে কারণে বঙ্গবন্ধুকে মুগ্ধ করেছিল | আমার দেখা নয়াচীন | Bangla Book Review by Enayet Chowdhury
Mao Tse-tung. Source: www.biography.com

তো এইখানে অনেক লোক আসছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সহ অন্যরা গেস করতেছিলেন টোটাল কত লোক হবে।

“আমাদের মধ্যে আলোচনা শুরু হলো কত লোক হবে। কেউ বলে ৫০ লক্ষ, কেহ বলে ৪০ লক্ষ, কেহ বলে এককোটি। ৪০ লক্ষের কম কেউ বললো না। আতাউর রহমান সাহেব বললেন, ৩০ লক্ষ তো হবেই। আমি কিন্তু ১৫ লক্ষ বললাম। সকলেই আমার উপর ক্ষেপে উঠলো। আতাউর রহমান সাহেব আমাকে বললেন, আপনার ধারণাই নেই। কী করবো! শেষ পর্যন্ত ২৫ লক্ষ লোক শোভাযাত্রা করেছে বলে ধরে নেওয়া গেল।”(পৃষ্ঠা ৫৬)

এই হইলো গেস। উনারা গেস করছে এতজন। তাইলে এখন চলেন দেখি আসলেই কতজন আসছিলো এন্ড চাইনিজ মিডিয়া বা প্রেসের মধ্যে যে কীভাবে ফলাও করে প্রচার করা হইছিলো।

“সকালে উঠে দেখি, হায় হায়! কম্যুনিস্ট দেশের সরকারি কাগজ সত্য কথা লেখে! একটু আশ্চর্য হয়ে গেলাম। লিখেছে ৫ লক্ষ লোকের শোভাযাত্রা।(কমেন্ট : কই ২৫ লক্ষ লোকের কাহিনী ওনারা চিন্তা করছিলো ওইজায়গায় মাত্র আসলে আসছিলো ৫ লক্ষ লোক!) কোথায় আমরা বলি ২৫ লক্ষ! আর সরকারি কাগজ লেখে পাঁচ লক্ষ। আশ্চর্য হলাম। মিছাই কি এদেশের জনসাধারণ সরকারকে ভালোবাসে?”(পৃষ্ঠা ৫৬)

বাট রিসেন্ট পরিস্থিতি অবশ্যই এইরকম না, চাইনিজ মিডিয়ার বিরুদ্ধে প্রচুর সমালোচনা আছে। বাট ওইসময়ে ওদের প্রিন্টিং প্রেস এরকম ফলাও করে নিজেদের এক্সপেরিয়েন্সকে ফুলায়া ফাঁপায়া বলে নাই এইটারই প্রশংসা বঙ্গবন্ধু এইখানে করছে।

এরপর আসে তৎকালীন চাইনিজদের কৃষি ব্যবস্থাটা কীরকম ছিল। ওদের একটা সময় এইরকম ছিল যে ওদের অনেক জমিদার ছিল, এন্ড ওদের বড় বড় অনেক জমিজমা ছিল। 

“এই সমস্ত জমিদাররা কোনো কাজ করতো না। বড় বড় শহরে এদের ভালো ভালো বাড়ি থাকতো, সেখানে আরামে মদ ও মেয়ে নিয়ে ফুর্তি করা হতো জমিদাররা অনেক জমি ফেলে রাখতো, কারণ তাদের খাস জমি চাষাবাদ হতো না। এইভাবে কোটি কোটি বিঘা জমি পড়ে থাকতো অনাবাদি হয়ে।” (পৃষ্ঠা ৮৮)

যখন থেকে নয়াচীন সরকার আসছে এই জমিদারদের শায়েস্তা করার জন্য ব্যবস্থা নিছে কেও বইসা বইসা জমি নিয়া খাবে এই ধারণাটা তৎকালীন সরকারের মধ্যে ছিল না!

“নয়াচীন সরকার কায়েম হওয়ার পরে তারা প্রথম কাজ শুরু করলেন, ‘লাঙ্গল যার জমি তার’ এই প্রথা প্রবর্তনের মাধ্যমে। বড় বড় জমিদারদের জমি বাজেয়াপ্ত করে গরিব জমিহীন কৃষকদের মধ্যে বণ্টন করে দিলো। সত্যিকারের কৃষক জমির মালিক হলো। যে সমস্ত অনাবাদি খাস জমি পড়ে ছিল, তাও ভাগ করে দিলো কৃষকদের মধ্যে। হাজার হাজার বেকার কৃষক জমি পেলো। যখন তারা বুঝতে পারলো জমির মালিক তারা, তাদের পরিশ্রমের ফল জমিদাররা আর ফাঁকি দিয়া নিতে পারবে না, তখন তারা পুরা উদ্যমে চাষাবাদ শুরু করলো। তবে একথা সত্য যে, নতুন চীন সরকার সকলকে সমান করে দেয় নাই, যা আমরা কম্যুনিস্টদের সম্বন্ধে শুনি।(কমেন্ট : এখানেও ওই আগের সমান করার ব্যাপারটার বিরুদ্ধে তিনি কথা বলতেছেন, যে ওইসময়ের কম্যুনিজমের মধ্যে উনি যেরকম এক্সপেক্ট করছিলেন সাম্যবাদ, ওইরকম পান নাই।) এখনও অনেক বড় চাষি জমির মালিক আছে, তারা লোক রেখে চাষাবাদ করে। তবে প্রয়োজনের অধিক যে জমি ছিল তা বাজেয়াপ্ত করে গরিব চাষিদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। নয়াচীনে একখণ্ড জমি দেখলাম না, যা অনাবাদি অবস্থায় পড়ে আছে। রেল লাইনের পাশে যে গর্ত গুলি পড়ে থাকে সেগুলিতেও ফসল করা হয়েছে যদি কোনো জমি ইচ্ছাকৃতভাবে পড়ে থাকে তাহলে সরকার কঠোর শাস্তি দেয়।

জমি যে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে তা পুরুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; স্বামী যাহা পাবে, স্ত্রীও সমপরিমাণ জমি পাবে এবং দুজনকেই পরিশ্রম করতে হবে। কারণ দুজনই জমির মালিক। স্বামী কাজ করবে আর স্ত্রী বসে খাবে এ প্রথা চীনের থেকে তুলে দেওয়া হয়েছে। আমি ট্রেন থেকে পুরুষ ও মেয়েলোক অনেককেই হাল-চাষ করতে দেখেছি।”(পৃষ্ঠা ৮৯-৯০)

এইখান থেকে মূলত শুরু হয় নতুন চায়নাতে পুরুষ এবং নারীদের যে সমানাধিকার এবং দুইজনের যে সমান দায়িত্ব আছে এইটার ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর মতামত দেওয়া। এই ব্যাপারে একটু পরে আবারও উনি বলতেছেন,

“নয়াচীনের মেয়েরা আজকাল জমিতে, ফ্যাক্টরিতে, কলে-কারখানাতে, সৈন্যবাহিনীতে দলে দলে যোগদান করছে। নয়াচীনে পুরুষ ও নারীর সমান অধিকার কায়েম হওয়াতে আজ আর পুরুষ জাতি অন্যায় ব্যবহার করতে পারে না নারী জাতির উপর। আমাদের দেশের কথা চিন্তা করে দেখুন। যদিও আইনে আমাদের দেশে নারী পুরুষের সমান অধিকার, তথাপি আমাদের দেশের শিক্ষিত অশিক্ষিত লোকের মনে এই ধারণা যে, পুরুষের পায়ের নিচে মেয়েদের বেহেশত। পুরুষ যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। মেয়েদের নীরবে সব অন্যায় সহ্য করতে হবে বেহেশতের আশায়। তার চেয়ে বড় কথা হচ্ছে, মেয়েদের নির্ভর করতে হয় পুরুষদের অর্থের উপর। কারণ আমাদের দেশে অশিক্ষিত ও অর্ধ শিক্ষিত কিছু সংখ্যক মোল্লা পর্দা পর্দা করে জান পেরেশান করে দেয়। কোনো পরপুরুষ যেন মুখ না দেখে। দেখলে আর বেহেশতে যাওয়া হবে না। হাবিয়া দোজখের মধ্যে পুড়ে মরবে। আমার দেশের সরলপ্রাণ গরিব অশিক্ষিত জনসাধারণ তাদের কথা বিশ্বাস করে আর বেহেশতের আশায় পীর সাহেবদের পকেটে টাকা গুঁজে দেয়, আর তাদের কথা কোরআন হাদিসের কথা বলে বিশ্বাস করে। কিন্তু ইসলামিক ইতিহাস পড়লে জানা যায় যে, মুসলমান মেয়েরা পুরুষদের সাথে যুদ্ধ ক্ষেত্রে যেত, অস্ত্র এগিয়ে দিতো। আহতদের সেবা শুশ্রুষা করতো হজরত রসুলে করিমের (সা.) স্ত্রী হজরত আয়েশা সিদ্দিকা নিজে বক্তৃতা করতেন, ‘দুনিয়ায় ইসলামই নারীর অধিকার দিয়াছে’।” (পৃষ্ঠা ৯৯-১০০)

এই প্যারাটা থেকে বোঝা যায় ওনার চিন্তা-ভাবনাটা আসলে কতটা প্রগ্রেসিভ ছিল ওই টাইমের মধ্যেই! যেই প্রগ্রেসিভ নেচারটা আমরা এখন ধইরা রাখতে পারি নাই(😓)। যেই প্রগ্রেসিভ নেচারটার অনেকটাই অনুপস্থিতি আমরা বর্তমান বাংলাদেশের সমাজে দেখতে পাই, Which is pretty alarming for us!

চীনে কিন্তু একসময় বেশ্যাবৃত্তি বা Prostitution যেইটাকে আমরা বলতেছি ওইটা অনেক বড় একটা সমস্যা ছিল। ওইটার বিরুদ্ধেও নয়াচীন সরকার ব্যবস্থা নিছে।

“দুনিয়ার মধ্যে চীনদেশ বেশ্যা বৃত্তির জন্য বিখ্যাত ছিল- বিশেষ করে সাংহাই শহর। কারণ, এ শহরটা বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শহরের মধ্যে অন্যতম। এই বেশ্যা বৃত্তির বিরুদ্ধে নয়াচীন সরকার জেহাদ ঘোষণা করলো। আইন করে না, মানবীয় ব্যবহার দ্বারা। সমাজসেবক ও নিঃস্বার্থ কর্মীদের উপর ভার পড়লো এই মেয়েরা কেন বেশ্যা হয় এবং এমন কুৎসিতভাবে জীবনযাপন করে অনুসন্ধানে তা বের করার। এরা কিছুদিন পর্যন্ত এদের অনেকের জীবনের ইতিহাস সংগ্রহ করেছিলো। আর একদিকে সরকার একটি কমিটি নিয়োগ করলো- কী করে এদের কাজ দেওয়া যায়, সমাজে পুনর্বাসন করা যায় সে বিষয়ে পরামর্শ দিতে। মানুষ না খেতে পেয়ে পেটের জন্য কী করতে পারে তা এদের জীবন নিয়ে আলোচনা করলে দেখা যায়। যাদের ইতিহাস নেওয়া হয়েছিল তাদের অধিকাংশই হলো না খেতে পেরে উপায়হীন অবস্থায় এসে বেশ্যাবৃত্তি অবলম্বন করেছে।” (পৃষ্ঠা ৯৫)

এই প্রবলেমটাকে আইডেন্টিফাই করে এবং সলিউশনের অ্যাপ্রোচটা আপনি দেখেন, ওরা কিন্তু ডিরেক্ট আইনের মাধ্যমে সেটাকে বন্ধ করতে যায় নাই! মূল গোঁড়ার প্রব্লেমটা কী সেটা আইডেন্টিফাই করে সেটাকে উৎপাটন করার মাধ্যমে তারা এই প্রবলেমটার সলিউশন কিন্তু করছে! যেটা আমাদের হয়তো অনেক বেশি পরিমাণে অনুসরণ করা উচিত, কারণ আমরা অনেক সময় মনে করে শাস্তি প্রদানের মাধ্যমেই যেকোনো একটা প্রবলেমকে আমরা সলভ কইরা ফেলতে পারবো। ব্যাপারটা কখনোই ওইরকম হয়না!

নয়াচীনে সমানাধিকার যে দেওয়া হয় না এইটার ব্যাপারে আবারো পৃষ্ঠা ১০৩ এ বঙ্গবন্ধু বলছেন,

“আমাদের দেশে প্রোপাগান্ডা হয় যে, নয়াচীনে সকলকে সমান করে দেওয়া হয়েছে- তা সত্য নয়। বড় বড় কর্মচারী গরিব কর্মচারীদের থেকে কিছুটা সুযোগ-সুবিধা বেশি পায়!  তাদের বেতনও বেশি। একথা সত্য যে, চীনে সকলে যাতে বাঁচবার মতো সুযোগ সুবিধা পায় তা সকলকে করে দেওয়া হয়। একজনে চাকরি করে লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যাংকে জমা করে আর একজন না খেয়ে কষ্ট করে তা উঠে গেছে আরাম করো আপত্তি নেই, তবে কেউ না খেয়ে থাকতে পারবে না, এই হলো নীতি। তাই আজকাল নয়াচীনে কোনো কর্মচারী ঘুষ খেতে পারে না, আর খেতে চায়ও না।”(পৃষ্ঠা ১০৩)

এইখান থেকে আমাদের দেশের ঘুষের যে কালচারটা সম্পর্কে সেই ১৯৫২ সালে কী ধরনের রীতি ছিল, এই ব্যাপারটা বঙ্গবন্ধু তুলে ধরছেন।

“১৪ বৎসরের রাজনীতিতে আমার শিখবার ও দেখবার যথেষ্ট সুযোগ হয়েছে। পূর্বে শুনতাম, দারোগা পুলিশের মতো কেউ ঘুষ কেউ খায় না। তারপর শুনতাম, সিভিল সাপ্লাইয়ের মতো কেউ ঘুষ কেউ খায় না তারপর শুনতাম কাস্টমস অফিসারদের মতো কেউ ঘুষ খায় না। আমি কয়েক বৎসর রাজবন্দি হিসেবে জেল খেটেছি, তাতে দেখেছি জেলখানার ঘুষের মতো বৈজ্ঞানিকভাবে ঘুষ বোধ হয় কোনো ডিপার্টমেন্টের কর্মচারীরা নিতে জানে না(😂)। কোনো দুর্নীতি দমন বিভাগের কর্মচারী উপায় নাই যে সে ঘুষ ধরে! জেলখানা, পুলিশ ডিপার্টমেন্ট, সিভিল সাপ্লাই ডিপার্টমেন্ট,  কাস্টমস, কোর্ট-কাচারি, সাব-রেজিস্ট্রার অফিস, ইনকাম ট্যাক্স, কারো চেয়ে কেউ কম না, এই ধারণাই আমার শেষ পর্যন্ত হয়েছে।” (পৃষ্ঠা ১০৪)

তার মানে ঘুষের কালচারটা আসলে সার্বজনীনভাবেই ছিল আমরা এইটাকে কীভাবে নির্মূল করতে পারি সেই সলিউশন খোঁজার জন্য হয়তো আমাদের আরও কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হবে। বাট বঙ্গবন্ধু নিজে যে এই ঘুষ বা দুর্নীতির বিরুদ্ধে কতটা কঠোর অবস্থানে ছিলেন, তার এই কথাগুলা থেকেই কিন্তু আমরা বুঝতে পারি। এইখান থেকে আমি আপনাদেরকে একটু শুরুর দিকে নিয়ে যাবো, যেখানে তিনি পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতদেরকে সমালোচনা করছেন উল্টাপাল্টা বেশি জাঁকজমকপূর্ণ চলাফেরা করার জন্য। কাহিনী হচ্ছে ওনারা রেঙ্গুন অর্থাৎ ব্রহ্মদেশ বলতেছেন যেইটা মায়ানমারের রাজধানী সেইখানে গেছেন ওইখানে যেয়ে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতের সাথে দেখা করতে গেছেন। এই সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু কী বলছেন…

“রাষ্ট্রদূত অনেক জাঁকজমকের সাথেই থাকেন, বিরাট অফিস ও বহু কর্মচারী তাকে সাহায্য করে দেখে মনে হলো, যাদের টাকা দিয়া এত জাঁকজমক তাদের অবস্থা চিন্তা করলেই ভালো হতো। তাদের ভাতও নাই, কাপড়ও নাই, থাকবার মতো জায়গাও নাই। তারা কেউ না খেয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘোরে। তাদেরই সামনে ছেলেমেয়েরা না খেয়ে তিলে তিলে মারা যায়। নীরবে শুধু অশ্রু বিসর্জন করে আর খোদার কাছে ফরিয়াদ জানায়। জানি না খোদার কাছে সে ফরিয়াদ পৌঁছে কিনা!”(পৃষ্ঠা ২৩)

বঙ্গবন্ধু সারাজীবন খুবই সাদাসিধা একটা জীবনযাপন করছেন কোনো Materialistic চিন্তাভাবনা (বস্তুবাদী চিন্তাভাবনা) যে আমার এত সম্পদ করতে হবে এই করতে হবে ওই করতে হবে এই ধরনের চিন্তাভাবনায় উনি যানই নাই। এন্ড এইটা উনার এই লেখার মধ্যেও কিন্তু ফুটে উঠছে। এবং রাষ্ট্রনায়ক যারা, রাষ্ট্রের যেই মাথা যারা, ওরা এই Materialistic চিন্তাভাবনা করতেছেন দেখে তিনি তাদের এই সমালোচনাটা করছেন।

ওই সম্মেলনে কাশ্মীর ইস্যু নিয়ে কিছু কথা হইছিলো। আমরা বর্তমানে কিন্তু জানি ভারত কাশ্মীরের মধ্যে কী করতেছে। সো একটু দেখা দরকার ওই সম্মেলনে রাষ্ট্রনায়কদের মধ্যে আসলে কাশ্মীর নিয়ে মনোভাবটা কী ছিল…!

“কাশ্মীর প্রস্তাব আমরা উত্থাপন করতে চাইলাম, কারণ ভারত জোর করে কাশ্মীর দখল করে রেখেছে। কাশ্মীর নিয়ে ভারত ও পাকিস্তান যুদ্ধ হলে বিশ্বযুদ্ধ লেগে যেতে পারে।  গণভোট হলে কাশ্মীরের জনগণ নিশ্চয়ই পাকিস্তানে যোগদান করবে। ভারতীয় ডেলিগেটদের মধ্যে একদল কাশ্মীর সম্বন্ধে আলোচনা করতে প্রথমে রাজি হলো না,  তারপর অন্যান্য দেশের চাপে পড়ে রাজি হলো। ডা. সাইফুদ্দিন কিচলু যিনি ভারতবর্ষের ডেলিগেটদের নেতা, তিনিও চেষ্টা করলেন। আমরা দু’দেশের ডেলিগেটরা এক জায়গায় হয়ে আলোচনা করে সর্বসম্মতিক্রমে একটা প্রস্তাব নিলাম। তার সারাংশ, কাশ্মীরে গণভোটের দ্বারা ঠিক হবে তারা কোন দেশে যোগদান করবে! কোন বিদেশী সৈন্যবাহিনী সেখানে থাকতে পারবে না। চীনের শান্তি কমিটি প্রস্তাব পাস করতে খুবই সাহায্য করেছিল। এই প্রস্তাবে দুনিয়ার কাছে প্রমাণ হয়ে গেল ভারত জোর করে কাশ্মীর দখল করে রেখেছে। কারণ পাকিস্তান বারবার গণভোটের দাবি করেছে। ভারত বাহানা করে গণভোট হতে দেয় নাই।”(পৃষ্ঠা ৪০)

এইখানে কিন্তু বঙ্গবন্ধু তুমুলভাবে কাশ্মীর ইস্যুতে ভারতের সমালোচনা করছেন! বাট এখানে মনে রাখতে হবে উনি কিন্তু তখন পাকিস্তান ডেলিগেট টিমের সদস্য ছিলেন। তারপরেও তার এই মতামতটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাশ্মীর ইস্যুর জন্য।

নয়াচীন যে কারণে বঙ্গবন্ধুকে মুগ্ধ করেছিল | আমার দেখা নয়াচীন | Bangla Book Review by Enayet Chowdhury
Source: www.edition.cnn.com

কারণ বর্তমানেও কাশ্মীর ইস্যু নিয়া অনেক আলোচনা হইতেছে, অনেক কথাবার্তা হইতেছে। ওইখানে দফায় দফায় সেনাবাহিনী সাধারণ মানুষের উপরে অত্যাচার চালাইতেছে।

নয়াচীন যে কারণে বঙ্গবন্ধুকে মুগ্ধ করেছিল | আমার দেখা নয়াচীন | Bangla Book Review by Enayet Chowdhury
Source: www.reuters.com

তৎকালীন সময়ে জাস্ট পাকিস্তান আর ভারত তো ভাগ হইছে, ওইসময় পাকিস্তান সম্বন্ধে অনেকে জানতোই না, তারা ইন্ডিয়ার একটা পার্ট মনে করতো পাকিস্তানকে। এই ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু যেটা বলছেন,

“পাকিস্তান সম্বন্ধে দুনিয়ায় কোনো বিশেষ প্রোপাগান্ডা হয় নাই। এটার প্রমাণ আমি ঢাকায় পেয়েছি। এক বন্ধুর বাড়িতে যাই। তার শালা আমাকে একটা চিঠি দেখালো, আমেরিকার একজন স্কুল মাস্টার লিখেছেন উপর ঠিকানা লেখা : ‘পাকিস্তান-ইন্ডিয়া’। এতেই দেখা যায়, আমাদের দূতেরা কি প্রোপাগান্ডাই না করেছে বিদেশে পাকিস্তান সম্বন্ধে! দুনিয়ার মানুষ জানে আমাদের লোকসংখ্যা কত? আর বাজেট কত? মাথাপিছু গড় আয় কত? আমাদের দেশের গ্রামে একটা কথা আছে,’ মিয়াঁর বাড়ি খাবার নাই, বাহির বাড়ি বড় কাচারি’, দশা হয়েছে তাই।”(পৃষ্ঠা ৪৫-৪৬)

একটু আগেই উনি এখানে বলছেন,

“দক্ষিণ আমেরিকার একটা দেশের ডেলিগেটের সাথে আলাপ হলো। তিনি বললেন, পাকিস্তান কি একটা স্বাধীন দেশ না ভারতের একটা প্রদেশ? আমি আশ্চর্য হয়ে চেয়ে রইলাম। ভাবলাম বোধহয় লোকটা দলে পড়ে এসেছে।  রাজনীতি দুনিয়ার খবর খুব রাখে না।”

তারমানে এখনো কিন্তু বাইরে অনেক সময়ই বাংলাদেশকে এটা শুনতে হয় যে বাংলাদেশ, ভারতের অংশ নাকি, ইন্ডিয়ার কোন একটা স্টেট নাকি বাংলাদেশ! সেই সময় পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও হুবহু এই একই মনোভাব বাইরের দেশের মানুষরাও হয়তো পোষণ করতো, এন্ড ওইটা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কোনোভাবেই পছন্দ ছিল না। 

এই বইটার সবচেয়ে বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুটা আমাকে যদি আপনি সিলেক্ট করতে বলেন আমি বলবো এই বইটার ছবিগুলা, পৃষ্ঠা ১৭২ থেকে ১৮৩ এর মধ্যে আছে। এই ছবিগুলা এত গুরুত্বপূর্ণ যে আমি এখন এই ছবিগুলা আপনাদেরকে দেখাবো না কারণ কপিরাইটের কিছু ইস্যু আছে এন্ড আপনাদের বইটা পড়তে হবে ছবিগুলা দেখার জন্য।

আমি বইয়ের খুবই সামান্য অংশ আপনাদের সামনে তুলে ধরছি। আপনাদের পুরা বইটা আসলে পড়া উচিত। এন্ড  পড়লে আপনারা আসলে কোন কোন বিষয়ে আরো ডিটেইলসে জানতে পারবেন ওইটার জন্যই এই ভিডিও। আমি বলবো অন্তত ছবির জন্য হইলেও আপনাদের এই বইটা পড়া উচিত!

লেখক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে যদি আমাকে আপনি বলতে বলেন, আমাদের অনেক বড় একটা ভাগ্য যে এরকম একজন রাষ্ট্রনেতা তার লেখনীও এত বেশি ক্ষুরধার ছিল! যদিও তিনি তার বইয়ের মধ্যে বলছেন তিনি আসলে লেখক না, তিনি তার অনুভূতিটাই শুধু প্রকাশ করতেছেন। বাট তারপরেও উনি যে লিখে গেছেন এবং তারপর আমরা যে পাণ্ডুলিপিটা এই পর্যন্ত পাইছি এন্ড লাস্ট পর্যন্ত বইটা প্রকাশিত হইছে এটা আমাদের জন্য অনেক বড় একটা সৌভাগ্যের বিষয়!

এইখানে আমি ভূমিকার কিছু কথা বলবো একদম লাস্ট প্যারাতে যেটা বলছেন। ভূমিকাটা লিখছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেটা আমরা অসমাপ্ত আত্মজীবনী কিংবা কারাগারের রোজনামচার মধ্যেও দেখছি। এইখানে উনি এই পাণ্ডুলিপিগুলা সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্ত্রী ফজিলাতুন্নেছা অর্থাৎ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মা তার অনেক গুণকীর্তন করছেন।

নয়াচীন যে কারণে বঙ্গবন্ধুকে মুগ্ধ করেছিল | আমার দেখা নয়াচীন | Bangla Book Review by Enayet Chowdhury
বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা💖

এবং অনেক সময়ই আমরা দেখতে পাই ফজিলাতুন্নেছার যেই অবদানটা এই বইগুলা প্রকাশের ক্ষেত্রে হয়তো সেটা আমরা খুব বেশি পরিমাণে জানি না। এটা একটু তুলে ধরি।

“সবসময়ে আমার মায়ের কথাই মনে পড়ে। আমার মা যে কত রাজনীতি-সচেতন ছিলেন, কত দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন,  আমার আব্বাকে তিনি লেখার প্রেরণা দিতেন। খাতাগুলি কিনে দিতেন আবার আব্বা যখন জেল থেকে মুক্তি পেতেন তখন খাতাগুলি সংগ্রহ করে সযত্নে রেখে দিতেন। তিনি নিশ্চয়ই আশা করেছিলেন যে এই লেখাগুলি একসময় বই আকারে ছাপা হবে। কিন্তু তিনি তা দেখে যেতে পারলেন না।  আমার মা দেখে যেতে পারলেন না তারই সযত্নে রাখা অমূল্য সম্পদ জনতার কাছে পৌঁছে গেছে। মায়ের কথাই সবসময় আমার মনে পড়ে। মাকে যদি একবার বলতে পারতাম,  দেখাতে পারতাম আব্বার লেখাগুলি পুস্তক আকারে প্রকাশিত হয়েছে তাহলে কত খুশি হতেন। মা, তোমার কথাই বারবার মনে পড়ে মা।

শেখ হাসিনা

৭ই ডিসেম্বর, ২০১৯” (পৃষ্ঠা ১৭)

এই বইয়ের ভূমিকাতে পাণ্ডুলিপি সংগ্রহের যে গল্পটা ওইটা নিয়ে উনি রেফারেন্স দিছেন অসমাপ্ত আত্মজীবনী আর কারাগারের রোজনামচা দেখতে। আমরা একটু অসমাপ্ত আত্মজীবনীর ভূমিকাতে যাবো। এই পাণ্ডুলিপিটা কীভাবে সংগ্রহ হইছে সেটা দেখার জন্য। আমার কাছে এই অসমাপ্ত আত্মজীবনীটাও আছে। তো এইটার ভূমিকার একটা অংশ আপনাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করতেছি পড়ে শোনানোর ব্যাপারে।

“১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট ৩২ নম্বর সড়কের বাড়িতে পরিবারের সকলকে হত্যার পর তৎকালীন সরকার বাড়িটা বন্ধ করে রেখেছিল। ১৯৮১ সালের ১৭ মে আমি প্রবাস থেকে দেশে ফিরে আসি। তখনও বাড়িটা জিয়া সরকার সিল করে রেখেছিল। আমাকে ওই বাড়িতে প্রবেশ করতে দেয় নাই।  এরপর ওই বছরের ১২জুন সাত্তার সরকার আমাদের কাছে বাড়িটা হস্তান্তর করে। তখন আবার লেখা স্মৃতিকথা, ডায়েরি  ও চীন ভ্রমণের খাতাগুলো পাই। আত্মজীবনী লেখা খাতাগুলো পাইনি। কিছু টাইপ করা কাগজ পাই যা উইপোকা খেয়ে ফেলেছে।”(শেখ হাসিনার লেখা ভূমিকার অংশবিশেষ, অসমাপ্ত আত্মজীবনী)

তার মানে এইখান থেকে আমরা যেটা জানতেছি, ‘৮১ পরবর্তী সময়ে যখন শেখ হাসিনা নতুন করে তার বাড়ির অধিকারটা আবার পান, ওই সময়ই ওই চীন ভ্রমণের ডায়েরিটা তার হাতে আসে এবং তার থেকেই এই আমার দেখা নয়াচীন বইটা আমরা এখন হাতে পাইছি। বইটা অবশ্য প্রকাশিত ২০২০ এর বইমেলায়। বইটা প্রকাশ করছে বাংলা একাডেমী। সো আমার অনুরোধ থাকবে আপনারা বইটা নিজেরা পড়বেন। নয়াচীন সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর যে ইনসাইটগুলা সেগুলা বোঝার চেষ্টা করবেন। কারণ তৎকালীন সময়ের ইতিহাসে এই জিনিসটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল এবং এখনও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ যদি আমরা নিজেদেরকে আরও বেশি ডেভেলপ করতে চাই। নয়াচীন ১৯৪৯ পরবর্তী বিপ্লবোত্তর সময়ে আসলে কী করতে চাইছিলো ওই ফিলোসফিটা আমাদেরকে অনেক বেশি পরিমাণে সাহায্য করবে হয়তো।

আজকের বুক রিভিউ এই পর্যন্তই।

নয়াচীন যে কারণে বঙ্গবন্ধুকে মুগ্ধ করেছিল | আমার দেখা নয়াচীন | Bangla Book Review by Enayet Chowdhury
বুঝলে ভুঝপাতা, না বুঝলে তেজপাতা😐

আপনারা আর নতুন কোন কোন বইয়ের রিভিউ চান আমার কাছ থেকে সেটাও আপনারা আমাকে কমেন্ট বক্সে জানাতে পারেন।  আজকে এই পর্যন্তই। সবাই ভালো থাকবেন। সুস্থ থাকবেন।

বইয়ের লিংকঃ https://www.rokomari.com/book/195529/…

প্রকাশনীঃ বাংলা একাডেমী

প্রচ্ছদ ও গ্রন্থ নকশাঃ তারিক সুজাত

গায়ের মূল্যঃ ৪০০ টাকা

পুরা ভিডিও দেখেন ইউটিউবে!



For Gaining more knowledge on this topic:-

India’s Modi outlines conditions for Kashmir elections in first talks since autonomy revoked

India’s Modi discusses Kashmir elections in first talks since autonomy revoked

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *